বানান ছাঁটাই অভিধান
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেন, “পৃথিবীতে কোনও সংস্কারই কখনও দল বেঁধে হয় না, একাকিত্ব দাঁড়াতে হয়। এর দুঃখ আছে। কিন্তু স্বেচ্ছাকৃত একাকিত্বের দুঃখ একদিন সংঘবদ্ধ হয়ে বহুর কল্যাণকর হয়।” দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বানান, লিপি এক সময় স্থবির ও নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তখন সে অসংগতি দূর করাও দরকার হয়। ভাষাসংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান সবার কাম্য। বহুক্ষেত্রে ভাষার রক্ষণশীল স্থবির নিয়মকে আধুনিককালের উপযোগী করে নিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার সকলের আন্তরিক উদ্যোগ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়। দ্বন্দ্ব সমাসের সমার্থকদ্বন্দ্ব বা একার্থক সহচর শব্দাবলি বাংলা ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে ঠিকই; কিন্তু সেখানেও এসেছে আপত্তি। ‘বাঙ্গালা শব্দকোষ’ অভিধানে সমার্থকদ্বন্দ্বকে যোগেশ চন্দ্র বিদ্যানিধি ‘সহচর’ শব্দ বলেন। ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ব্যাকরণ-বিভীষিকা’ গ্রন্থে এ জাতীয় শব্দের দ্বৈতপ্রয়োগ বা পুনরুক্তি দোষ বলে আপত্তি করেছেন। অনেক সময় শব্দের শেষে তা, ত্ব প্রত্যয় যোগ করার নিয়ম অমান্য করার মাধ্যমে শব্দের অপকর্ষ বা অপপ্রয়োগে জটিলতা তৈরি হয়। ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “তা, ত্ব গুণবাচক বিশেষ্যপদ গঠন করে, গুণবাচক/অবস্থাবাচক বিশেষ্যপদের সঙ্গে এটি যোগ করলে ভুল হয়। যেমন—উৎকর্ষতা, ভারসাম্যতা, সৌজন্যতা।” সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘বাঙ্গলা ভাষা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থে বলেন, “একই পদের পুনরাবৃত্তি ছাড়াও এক শ্রেণির যুগ্মশব্দকেও—রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘জোড় মেলানো শব্দ’ বা ‘জোড়াশব্দকেও’—শব্দদ্বৈতের মধ্যে ধরা হয়, যেমন—মাথামুন্ডু, লোকজন, কাগজপত্র, আপদ-বিপদ, সাজানো-গোছানো, ধীরে-সুস্থে, ভেবে-চিন্তে, বলতে-কইতে …।” ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ গ্রন্থে এ জাতীয় শব্দকে সমাস না বলে সমার্থকশব্দদ্বৈত বলা হয়। বাস্তবিকপক্ষে বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের দ্বৈত প্রয়োগ অনেক সময় ভাষার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। প্রাচীনকালের আদিম মানব সংগীতপ্রিয় ছিল। সেজন্য তাদের দ্বিত্ব উচ্চারণ প্রবণতা থেকে পরবর্তীকালে বৈদিক ও সংস্কৃতে দ্বিগুণিত পদ ব্যবহারের উদ্ভব হয়। দৈনন্দিন কথাবার্তায়, পদ্যে, নাটকের সংলাপে অবলীলাক্রমে দ্বিগুণিত বা শব্দদ্বৈত চললেও আচারিক বা আনুষ্ঠানিক ভাষায় এর প্রয়োগকে অনেকটাই অপ্রয়োগ বলা চলে। বৈদিক, সংস্কৃত প্রভৃতি উন্নতমানের ভাষাগুলোতে পুনরাবৃত্তির ব্যাপক ব্যবহার নেই; একঘেমেয়ি দূরীকরণের লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তির বদলে ওইসব ভাষায় অন্য নিয়ম অনুসৃত হয়েছিল। ‘সঠিক’ শব্দকে নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। ড. আনিসুজ্জামান, আহমদ শরীফ, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ গ্রন্থে ‘সঠিক’ শব্দকে অশুদ্ধ বলেন। তাঁরা যুক্তি হিসাবে দেখান ঠিক-এর সঙ্গে ‘স’ যোগ করা শব্দ গঠনগত অহেতুক বাহুল্য। ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’-এ ‘সক্ষম’ শব্দকে অশুদ্ধ বলা হয়। ‘চলন্তিকা’ অভিধানেও ‘সক্ষম’; ‘সচল’ শব্দকে অশুদ্ধ বলা হয়। এ ছাড়া উৎকর্ষ-অপকর্ষের তারতম্য বোঝানোর জন্য সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে তর, তম, ইষ্ঠ, ঈয়স প্রত্যয় যোগ করতে গিয়েও ভুল করা হয় যেমন—‘বলিষ্ঠতম’; ‘শ্রেষ্ঠতম’। অনেক শব্দে অহেতুক মেদ জমেছে, যেমন—‘অদ্যাপিও’; ‘কদাপিও’; ‘তবুও’। এদের ছাঁটাই করা দরকার। অকারণ লিঙ্গান্তর শব্দকে বিষিয়ে তুলেছে, যেমন—‘আধুনিকা’; ‘নির্দোষী’; ‘নিরোগী’। ‘কেবলমাত্র’; ‘শুধুমাত্র’ শব্দকে যদি বহুলপ্রচলিত অশুদ্ধ শব্দ ধরা হয়, তা হলে এ অভিধানে এরকম অনেক বহুলপ্রচলিত পুনরুক্তিদোষযুক্ত শব্দ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিছু কথ্যরীতির শব্দ, প্রচলিত অথচ পরিবর্তিত শব্দ, বিযুক্ত শব্দ ভুক্তিতে স্থান পেয়েছে। কিছু শব্দের বানান ছাঁটাই করা যুগের দাবি। কোনও শব্দ বা বিষয় সম্পর্কে জানার অধিকার সবার রয়েছে; কিন্তু তা মানার বেলায় চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এ অভিধান সংকলন করা হয়নি। আমি কোনও ভাষাবিদ নই, একজন শব্দপ্রেমিক হিসাবে কেবল কিছু শব্দ সম্পর্কে জানার কৌতূহলের কারণে এই অভিধান সংকলন করার চেষ্টা করেছি। ব্যাকরণিক যুক্তি থেকে যেসব শব্দ গ্রাহ্য বা বর্জিত মনে হবে, তা গ্রহণ বা বর্জনের স্বাধীনতা পাঠকের আছে। অভিধানটি যদি সামান্য কাজে লাগে তাতেই আমি অনেক ধন্য হব।
যে-কোনও অভিধানে শব্দের শুদ্ধ বানান দেখানো হলেও এই অভিধানে কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি শব্দের শিরোনামে প্রচলিত অশুদ্ধ বানান দেখানো হয়েছে। তবে শিরোনামে তৃতীয় বন্ধনীর ভিতরে শব্দের সিদ্ধ/শুদ্ধরূপ দেখানো হয়েছে। কাজেই এই অভিধানের নাম ‘বানান ছাঁটাই অভিধান’ হলেও এটাকে ‘বাংলা ভুল শব্দের অভিধান’ও বলা যেতে পারে।
Reviews
There are no reviews yet.